শীর্ষ প্রশ্ন
সময়রেখা
চ্যাট
প্রসঙ্গ

বাঙালি জাতি

বাঙালি জনগোষ্ঠী উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ

বাঙালি জাতি
Remove ads

বাঙালি বা বাঙালী ([baŋali, baŋgali] (শুনুন) হলো দক্ষিণ এশিয়ার একটি ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠী,[৩৭] যারা বঙ্গ অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দা এবং বর্তমানে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বরাক উপত্যকা, নিম্ন আসাম[৩৮] এবং মণিপুরের কিছু অংশে বিভক্ত হয়ে বসবাস করে। বাঙালিরা মূলত ইন্দো-আর্য পরিবারের অন্যতম একটি ধ্রুপদী ভাষা বাংলায় কথা বলে।

দ্রুত তথ্য মোট জনসংখ্যা, উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল ...

বাংলাদেশের সংবিধানের ৬ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে যে,[৩৯]

“বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।”[৪০]

হান চীনাআরবের পরে বাঙালিরা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। এভাবে, তারা হলো ইন্দো-ইউরোপীয়দের মধ্যে বৃহত্তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ জাতিগোষ্ঠী। বাংলাদেশ এবং ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, এবং আসামের বরাক উপত্যকার বাইরেও, ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বসবাস করে। ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, দিল্লি, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং উত্তরাখণ্ড রাজ্যগুলোতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাঙালিরা বাস করে। এছাড়া, নেপালের প্রদেশ নং ১-এও বাঙালিদের উপস্থিতি রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান, মায়ানমার, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ইতালি, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াতেও ব্যাপক বাঙালি অভিবাসী সম্প্রদায় (বাংলাদেশী বাঙালি এবং ভারতীয় বাঙালি) গড়ে উঠেছে।

বাঙালিরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এক বৈচিত্র্যময় জাতিগোষ্ঠী। বর্তমানে, প্রায় ৬৮% বাঙালি ইসলামের অনুসারী, এবং এছাড়াও বৃহৎ সংখ্যায় হিন্দু এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় খ্রিস্টানবৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রয়েছেন। মূলত বাংলাদেশে বসবাসকারী বাঙালি মুসলিমরা প্রধানত সুন্নি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামের বরাক উপত্যকা, ঝাড়খণ্ড, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী বাঙালি হিন্দুরা সাধারণত শাক্ত বা বৈষ্ণব মতাবলম্বী এবং এছাড়াও অঞ্চলভিত্তিক দেবদেবীদের উপাসনা করে। এছাড়াও অল্পসংখ্যক বাঙালি খ্রিস্টান রয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই পর্তুগিজ নাবিকদের বংশধর। এছাড়াও বাঙালি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের অধিকাংশই দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম ও বার্মার রাখাইনে বসবাসকারী বাংলাভাষী বড়ুয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত (বাংলাদেশের অন্যান্য বৌদ্ধদের সাথে যাদের গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়, যারা ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্য)। এছাড়াও পশ্চিমবাংলার রাঢ় অঞ্চলে "সরাক" নামে একটি বাঙালি জৈন সম্প্রদায়ও বসবাস করেন।[৪১]


ইতিহাসের অন্যান্য বৃহৎ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মতো, বাঙালিরাও শিল্প ও স্থাপত্য, ভাষা, লোককথা, সাহিত্য, রাজনীতি, সামরিক, ব্যবসা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে এবং অবদান রেখেছে।

Remove ads

নামের ব্যুৎপত্তি

সারাংশ
প্রসঙ্গ
Thumb
চর্যাপদ, বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন।

"বাঙালি" শব্দটি এমন একজন ব্যক্তি বর্ণনা করে, যার ভাষাগত, বংশগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় মূলত বাংলার মাটি থেকে উদ্ভূত এবং এ ইন্দো-আর্য বাঙালি জাতিটি বঙ্গের অন্যান্য অনার্য জাতি থেকে আলাদা। থানজাভুরের বৃহদীশ্বর মন্দিরের একটি শিলালিপিতে 'বাঙ্গালম্' শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায় যা বাংলা অঞ্চলের প্রাচীন পাথুরে প্রমানগুলোর একটি।[৪২] একাদশ শতকের দক্ষিণ ভারতের একাধিক শিলালিপিতে এই ভূখণ্ডকে বাঙ্গালাদেশ নামে উল্লেখ করা হয়েছে।[৪৩][৪৪] বাঙালি এবং বাংলা উভয় শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে সংস্কৃত বঙ্গ বা বাঙ্গালা শব্দ থেকে[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] যা ফার্সি ভাষায় বিবর্তিত হয়ে মধ্যযুগে বাঙ্গালাহ্ হয়েছিল। অতীতে বাংলা অঞ্চলটি অসংখ্য ভূ-রাজনৈতিক উপরাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। যেমন: দক্ষিণাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চল বঙ্গ (যার নাম থেকেই বাঙ্গালা শব্দ এসেছে বলে সাধারণত ধারণা করা হয়), পশ্চিমাঞ্চল রাঢ়, উত্তরাঞ্চল পুণ্ড্রবর্ধনবরেন্দ্র ও পূর্বাঞ্চল সমতটহরিকেল উপরাজ্যে বিভক্ত ছিল। আনুমানিক ২৩০০ বছর আগে বাংলায় মৌর্যদের শাসনকালে অবিভক্ত বঙ্গদেশের সর্বপ্রাচীন শিলালিপি মহাস্থানগড় ব্রাহ্মী শিলালিপিতে বাঙালি জাতির প্রাচীন পাথুরে প্রমাণ পাওয়া যায়। এই লিপিতে বাংলার প্রাচীন পুণ্ড্রনগরীর অধিবাসীদের "সংবঙ্গীয়" জাতিরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।[৪৫][৪৬] আনুমানিক ৭২০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সমতট অঞ্চলের দেব রাজবংশের রাজা মহারাজ আনন্দদেবের কুমিল্লার ময়নামতির তাম্রশাসনে "বাঙ্গালা" শব্দের একটি প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায়। তাম্রশাসন থেকে জন্য যায় মহারাজ আনন্দদেব "শ্রী বাঙ্গালা মৃগাঙ্ক" উপাধি ব্যবহার করতেন, যার অর্থ বাঙ্গালার চন্দ্র।[৪৭][৪৮]

ইব্রাহিমীয়ভারতীয় ধর্মগুলির ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, প্রাচীন বঙ্গরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছে বঙ্গ নামক এক ব্যাক্তি, যিনি এই অঞ্চলে প্রথম বসবাস করা শুরু করেন। ইব্রাহিমীয় বংশবিজ্ঞানীরা ধারণা করতেন যে, বঙ্গ ছিল নূহের ছেলে হামের নাতি।[৪৯][৫০][৫১] ধারণা করা হয়, 'ঐতরেয় আরণ্যক' গ্রন্থে প্রথম 'বঙ্গ' শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপুর্ব ৩০০ সালে।

মোঘল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল ইবনে মুবারক নিজের আইন - ই-আকবরী গ্রন্থে দেশবাচক বাঙ্গালা (বাংলা) শব্দ ব্যবহার করেন। তিনি বাঙ্গালা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে দেখান যে, প্রাচীন নাম বঙ্গের সাথে বাধ বা জমির সীমানাসূচক শব্দ 'আল/আইল' প্রত্যয়যোগে বাঙ্গালা শব্দ গঠিত হয়। এছাড়া ভারতীয় ইতিহাসবিদ গোলাম হোসেন সেলিমের বই রিয়াজুস সালাতিনেও এই উৎপত্তির বর্ণনা আছে।[৪৯]

১৩৫২ সালে হাজী শামসুদ্দীন ইলিয়াস নামে একজন মুসলিম অভিজাত শাসক শাহী বাঙ্গালা নামে একটি সালতানাত প্রতিষ্ঠা করে এই বিভক্ত অঞ্চলকে প্রথম একত্র করেন। ইলিয়াস শাহে বাঙালিয়ান উপাধী গ্রহণ করে নিজেকে অখণ্ড বাংলার শাসক ঘোষণা করেন।[৫২] এই যুগেই বাংলা ভাষা প্রথম রাষ্ট্রীয় সমর্থন পেয়ে সাহিত্যিক উন্নয়ন প্রতিপাদন করে।[৫৩][৫৪] এভাবেই ইলিয়াস শাহ "বাঙালি" নামে এই অঞ্চলের মানুষদের সামাজিক এবং ভাষাগত পরিচয় আনুষ্ঠানিকভাবে রূপান্তরিত করেন।[৫৫]

Remove ads

ইতিহাস

সারাংশ
প্রসঙ্গ

প্রাচীন ইতিহাস

Thumb
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের প্রাচীন রাজনৈতিক মানচিত্র

প্রত্নতাত্ত্বিকরা বৃহত্তর বাংলা অঞ্চলে সাড়ে চার হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন নব্যপ্রস্তরযুগ এবং তাম্র যুগের সভ্যতার অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন, এবং তারা বিশ্বাস করেন যে আবিষ্কারগুলি এই অঞ্চলে বসতি স্থাপনের প্রথম দিকের লক্ষণগুলির মধ্যে একটি। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা প্রায় ৪,৭০০ বছর পুরোনো নব্যপ্রস্তরযুগ এবং তাম্র যুগ-এর একটি সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন, যেমন- বাঁকুড়ার ডিহর[৫৬] এবং বর্ধমানের পাণ্ডু রাজার ঢিবি।[৫৭] ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ঊর্ধ্ব গন্ধেশ্বরী, মধ্য দ্বারকেশ্বর, ঊর্ধ্ব কংসাবতী, ঊর্ধ্ব তরাফেনি এবং মধ্য সুবর্ণরেখা নদী উপত্যকায় একটি প্রস্তর নির্মিত সরঞ্জাম ও একটি হাত কুড়াল পাওয়ার মাধ্যমে আরও প্রাচীন আদিম প্রস্তর যুগের মানব বসতির প্রমাণ মিলেছে।[৫৮] বাংলায় ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত হাতপাড়ায় প্রায় ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ বছর আগের মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।[৫৯][৬০] যাইহোক, রাঙ্গামাটিফেনী জেলায় পাথরের একটি যন্ত্র এবং একটি হাত কুড়াল আকারে অনেক পুরাতন পুরা প্রস্তর যুগের বসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।[৬১] পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় ৪২,০০০ বছর আগের প্রাচীন মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।[৬২][৬৩][৬৪]

Thumb
টলেমির আঁকা মানচিত্রে বাংলার প্রাচীন গঙ্গাহৃদি সাম্রাজ্য।

গঙ্গাহৃদি যুগের প্রাচীন প্রত্নবস্তুগুলি থেকে বোঝা যায় যে উত্তর চব্বিশ পরগনার চন্দ্রকেতুগড় যা, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৩০০ সালে এবং উয়ারী-বটেশ্বর-এর সভ্যতা যা বর্তমানে ঢাকার নরসিংদীতে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ সালের দিকে গড়ে উঠেছিল। চন্দ্রকেতুগড় এবং উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে বাংলার প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। নদী থেকে দূরে না হওয়ায় এই বন্দর-শহরটি প্রাচীন রোম, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলের সাথে বৈদেশিক বাণিজ্যে নিমগ্ন ছিল বলে মনে করা হয়। এই সভ্যতার লোকেরা ইটভাটা বাড়িতে বাস করত, চওড়া রাস্তায় হাঁটত, রুপালী মুদ্রা ও লোহার অস্ত্র ব্যবহার করত এবং আরও অনেক কিছুও করত। এটিকে বাংলার এবং সমগ্র উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীনতম শহর বলে মনে করা হয়।[৬৫]

ধারণা করা হয় যে বঙ্গ নামে একটি জনগোষ্ঠী দক্ষিণ এবং পূর্ব বাংলায় বঙ্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে এই অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। অথর্ববেদ এবং হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতে উত্তর বাংলার পুন্ড্র রাজ্যের সাথে এই রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে। মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং তাদের সম্রাট অশোকের দ্বারা বৌদ্ধধর্মের প্রচার খ্রিস্টপূর্ব দোসরা শতাব্দী থেকে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান বৌদ্ধ সমাজ গড়ে তুলেছিল। মধ্যপ্রদেশের সাঁচীর স্তূপ পর্যন্ত বহুত মৌর্য স্মৃতিস্তম্ভগুলি এই অঞ্চলের লোকদের বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হিসাবে উল্লেখ করেছিল। এই অঞ্চলের বৌদ্ধরা বহু মঠ নির্মাণ ও ব্যবহার করেছিল, এবং দক্ষিণ ভারতের নাগার্জুনকোণ্ডা পর্যন্ত তাদের ধর্মীয় প্রতিশ্রুতির জন্য স্বীকৃত ছিল।[৫৩]

বৈদেশিক রচনায় বাংলার প্রথম উল্লেখ দেখা যায় ইউনানী বা গ্রিকদের লেখায় ১০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি। তাতে বর্ণিত আছে গাঙ্গেয় সমতলভুমিতে বাসকারী গঙ্গারিডাই (গঙ্গার হৃদয়) নামে জাতির শৌর্যবীর্যের কথা যা শুনে মহাবীর আলেক্সান্ডার তার বিশ্ববিজয় অসম্পূর্ণ রেখে বিপাশা নদীর পশ্চিম তীর থেকেই প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।[৬৬]

প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী, উরাল পর্বতের আশেপাশের অঞ্চল (তুরস্ক, ইরান, মধ্য এশিয়া ইত্যাদি) থেকে আর্যরা খাইবার গিরিপথ বা প্রাচীন সিল্ক রোড ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে আসে। এ অঞ্চলে তখন স্থানীয় আদিবাসী দের বসবাস ছিলো। তারা ছিলে কোল, ভীম, মুন্ডা ও সাঁওতাল ইত্যাদি জনগোষ্ঠী, যারা অনার্য হিসেবে পরিচিত। আর্যরা তাদের উৎখাত করে, হত্যা করে, তাদের সাথে বংশবৃদ্ধি করে ভারতবর্ষে সর্বত্র সংকর জাতিগোষ্ঠী তৈরি করে। অস্ট্রিক এবং দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী তাদের থেকেই তৈরি। বাঙালি জাতির মূল অংশ অস্ট্রিক জাতি থেকে আগত। দ্রাবিড়রা দক্ষিণ ভারতীয় এবং আর্যদের পাশাপাশি এরাও বাঙালি জাতিতে মিশে আছে। ১২০৪ সালে তুর্কীদের বাংলা জয়ের পর আরবদের এবং পার্সিয়ানদের সাথে এ জনপদের অনেক মানুষের সাথে সংকরায়ন ঘটে এবং ধীরে ধীরে ভিত্তি সুদৃঢ় হতে থাকে। চট্টগ্রাম, তাম্রলিপ্ত এবং সপ্তগ্রাম বন্দরে প্রাচীন মিশরীয়দের আগমন, ব্যাবসা, এদেশে বিয়ে ইত্যাদি বিষয়গুলোও বাঙালি জাতির মিশ্র ডিএনএ-র ভিত্তি।[৬৭]

সুলতানী আমল

Thumb
গাজী পীর সম্ভবত ১২-১৩তম শতাব্দীতে সুন্দরবনে থাকতেন।
Thumb
খ্রিষ্টীয় ১৫ শতাব্দীকালে পর্তুগিজ চিত্রকরের আঁকা বাঙালিদের ছবি।

ষষ্ঠ শতকের শেষে দেশীয় রাজা শশাঙ্ক গৌড় নগরীকে কেন্দ্র করে একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করে যা বঙ্গদেশ থেকে ভুবনেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[৬৮] তারপর কিছুদিন অরাজকতার পর বৌদ্ধধর্মাবলম্বী দেশী পাল বংশ এখানে চারশো বছর রাজত্ব করে। পাল সাম্রাজ্য সুসম্পর্ক রেখেছিল শ্রীবিজয়া রাজ্য, তিব্বত সাম্রাজ্য, ও আরব আব্বাসী খেলাফতের সাথে। ইসলামধর্ম বাংলায় প্রথম এসেছিল পাল রাজত্বের কালে, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে ব্যাবসায়ের ফলে।[৬৯] দশম শতাব্দীতে দক্ষিণপূর্ব বাংলার সমতটের বাসিন্দারা বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ছিলেন। এসময়ে, আরব ভূগোলবিদমুরূজুজ্জহব বইয়ের লেখক আল-মাসুদী বাংলায় সফর করেছিলেন যেখানে উনি একটি মুসলমান সমাজকে দেখতে পান।[৭০] ব্যবসা ছাড়াও, বহু সুফীদের দ্বারা বাংলায় ইসলামের প্রচার করা হয়েছিল। প্রথম পরিচিত সুফীরা ছিলেন ১১তম শতাব্দীর সৈয়দ শাহ সুর্খুল আন্তিয়া ও তাঁর শাগরেদগণ, যার মাঝে শাহ সুলতান রূমী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। শাহ সুলতান রূমী নেত্রকোনার মদনপুরে বসবাস করেছিলেন যেখানে উনি সামন্ত রাজা ও তাঁর নাগরিকদেরকে ইসলাম গ্রহণ করার দাওয়াত দিয়েছিলেন।

পাল বংশের পর অপেক্ষাকৃত কম সময় রাজত্ব করে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু সেন রাজবংশ, যারা দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছিলে। পরবর্তীকালে বাংলা ইসলামী রাজত্বের অধিকারভুক্ত হলে বাংলায় প্রায় সব অঞ্চলেই দ্রুত ইসলামের প্রসার ঘটে।[৭১] তুর্কী সেনাপতি বখতিয়ার খলজী সেন বংশের রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বাংলার এক বিশাল অংশ দখল করেন। তার বাদে বিভিন্ন সুলতানরা এবং সামন্ত মালিকরা বাংলায় রাজত্ব করে শত শত বছর ধরে। খলজীর প্রাথমিক বিজয়ের ফলে ইসলাম প্রসারকদের মহাপ্রবাহ ঘটে। সুলতান বলখীশাহ মখদূম রূপস উত্তর বাংলায় বসবাস করে সেখানকার জনগণের কাছে ইসলাম প্রচার করেন। উত্তরপূর্বের হিন্দুশাসিত নগরী শ্রীহট্টেও ১৩ মুসলমান পরিবারের উপস্থিতি ছিল। ১৩০৩ সালে, শত শত সুফী-দরবেশ শাহ জালালের নেতৃত্বে লখনৌতির মুসলিম সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহকে শ্রীহট্টের বিজয়ে সহায়তা দেন, যার ফলে এই নগরী শাহ জালালের ধর্মীয় কার্যক্রমের সদর হয়ে ওঠে। বিজয়ের পর, জালাল তাঁর শাগরেদদের বাংলার বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করার নির্দেশ দেন এবং উনার নাম বাঙালিদের মধ্যে সুপরিচিত হয়।[৭২]

১৩৫২ সালে শাহী বাংলা নামে স্বাধীন একত্র বাংলার প্রতিষ্ঠায়, শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ দেশের মানুষদের সামাজিক ও ভাষাগত পরিচয় আনুষ্ঠানিকভাবে রূপান্তরিত করেন "বাঙালি" নাম দিয়ে।[৫৫] সুলতানি আমল দুই শতাব্দীরও বেশি সময় স্থায়ী হয়েছিল। ইলিয়াস শাহী রাজবংশ ইসলামী বৃত্তি স্বীকার করেছিল, এবং জাতি নিয়ে কোন ভেদাভেদ ছিল না। উসমান সিরাজুদ্দীন, যিনি আখি সিরাজ বাঙালি নামেও পরিচিত, ছিলেন উত্তর বাংলার গৌড়ের অধিবাসী এবং ইলিয়াস শাহের শাসনকালে উনি শাহী বাংলার রাষ্ট্রীয় আলিম নিযুক্ত হন।[৭৩][৭৪][৭৫] ফার্সী ও আরবীর পাশাপাশি, এই সুন্নি রাজ্যটি বাঙালি জাতির মুখের ভাষাকে স্বীকৃতি ও সমর্থন প্রদান করে (আগের রাজ্যগুলোর পরিবর্ত, যারা শুধুমাত্র সংস্কৃত, পালি ও ফার্সী ভাষাগুলোকে রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকার করতেন)।[৫৩][৫৪] হিন্দু-জন্মা সুলতান জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ মধ্যপ্রাচ্যের মক্কামদিনায় ইসলামী বিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ অর্থায়ন করেছিলেন। আরবের মানুষ এই বিদ্যালয়গুলিকে "আল-মদারিস আল-বঙ্গালিয়া" (অর্থাৎ বাঙালি মাদ্রাসাগুলো) নামে ডাকতেন।

মোগল আমল

Thumb
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাঙালি গোলন্দাজ।
Thumb
শেখ মুহম্মদ আমীরের আঁকা বাংলার একজন সহিস যিনি দুটি ঘোড়ার গাড়ি ধরে রেখেছেন।

ষোড়শ শতাব্দীতে মোগল সাম্রাজ্য বাংলা জয় করে সালতানাতের অবসান ঘটায় এবং আস্তে আস্তে বাংলার প্রতিটি বিদ্রোহী বারো-ভূঁইয়াদের পরাজিত করে। মোগল সেনাপতি মানসিংহ বাদশাহ আকবরের সময় ঢাকাসহ বাংলার কিছু অংশ জয় করেন এবং তার ফৌজ থেকে কিছু রাজপুত স্থায়ীভাবে ঢাকায় ও আশেপাশে বসতি স্থাপন করে বাঙালি সমাজের সাথে মিশ্রণ শুরূ হয়। বাদশাহ আকবরের দীন-ই-ইলাহীর সমন্বিত প্রচারকে বাংলার কাজী ইসলাম-বিরোধী হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন, যা দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে, বাঙ্গালী মুসলমান বুদ্ধিজীবিদের বহু আলিম-ওলামা ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ইসলাম প্রচারের জন্য চলে গিয়েছিলেন যেমন আলী শের বাঙ্গালী গুজরাতে, ওসমান বাঙ্গালী উত্তর প্রদেশের সম্ভলে এবং ইউসুফ বাঙ্গালী মধ্য প্রদেশের বুরহানপুরে[৭৬]

১৭তম শতাব্দীর গোড়ার দিকে, মোগল সেনাপতি ইসলাম খাঁ সমগ্র বাংলা জয় করেছিলেন এবং সুবাহ বাংলা গঠন করেছিলেন। এটি ছিল মোগল সাম্রাজ্যের বৃহত্তম সুবাহ, কারণ এটির মধ্যে বিহার এবং ওড়িশার অংশগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিল। বারুদ সাম্রাজ্যের একটিতে শুষে নিয়ে, সুবাহ বাংলা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ধনী অঞ্চলে পরিণত হয় এবং এর প্রাক-শৈল্পিক অর্থনীতি শিল্প বিপ্লবের একটি নিশানা দেখায়।[৭৭] বাঙালিরা সেই সময়ে দুনিয়ার কিছু সর্বোচ্চ জীবনযাত্রার মান এবং প্রকৃত মজুরি উপভোগ করেছিল,[৭৮] যা বুদ্ধিজীবিদের দ্বারা "মুলুকগুলির বেহেশ্ত" এবং "বাংলার স্বর্ণযুগ" হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল।[৭৯][৮০][৮১] এককভাবে সুবাহ বাংলা ইউরোপীয় মহাদেশের বাইরে সকল ওলন্দাজ আমদানীর ৪০% জন্য দায়ী ছিল।[৮২][৮৩] পূর্ব বাংলা পোশাক উৎপাদন এবং জাহাজ নির্মাণের মতো শিল্পে দুনিয়াব্যাপী বিশিষ্ট ছিল এবং দুনিয়ার রেশম এবং তুলাবস্ত্র, ইস্পাত, সল্টপিটার এবং কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যগুলির একটি প্রধান রপ্তানীকারক ছিল।[৮৪]

১৭০৭ সালে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের জীবনাবসানের পরে, মোগল বাংলা অবশেষে ১৭১৭ সালে মুর্শিদাবাদের নবাবদের দ্বারা শাসিত একটি আধা-স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়। বাংলার নবাবরা দিল্লির মোগল শাসকদের শাসন কেবল নামে মাত্র মানতেন। ইতিমধ্যেই প্রাক-শিল্পায়ন দেখা যায় বাংলায়, এটি প্রথম শিল্প বিপ্লবে সরাসরি জরূরী অবদান রেখেছিল (উল্লেখযোগ্যভাবে শিল্প বিপ্লবের সময় পোশাক উৎপাদন)।[৮৫][৮৬][৮৭][৮৮]

Thumb
১৮তম শতাব্দীর সূক্ষ্ম মসলিন পরা ঢাকার একজন বাঙালি নারী।

ইংরেজ দখল

বাংলা ইংরেজ-মোগল যুদ্ধের ভিত্তি হয়ে ওঠে।[৮৯][৯০] ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার মাটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধীনে পড়ে। ১৭৭২ সালে মুর্শিদাবাদের বদলে কলকাতাকে ইংরেজ ভারতের রাজধানী করা হয়। ইংরেজ শাসনের সময় বেশ কয়েকবার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, বিশেষ করে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং পঞ্চাশের মন্বন্তর, প্রতিটিতে লাখ লাখ বাঙালি মারা যান।

স্বাধীনতা আন্দোলন

বাঙালিরা স্বাধীনতা আন্দোলনে খুবই জরূরী ভূমিকা পালন করে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের ফলে শাসন ক্ষমতা যে ইংরেজদের হাতে চলে গিয়েছিল, এটা বুঝতে এখানকার জনগণের বেশ সময় লেগেছিল। ১৭৬০ সালে চট্টগ্রামের এবং ১৭৬৫ সালে বাংলার দেওয়ানি লাভের সাথে শাসন ক্ষমতাও তারা কুক্ষিগত করতে অগ্রসর হয়। পলাশীর যুদ্ধের বাদে এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন জনমনে বিশেষ রেখাপাত করেনি। পরিস্থিতির প্রতি অসন্তোষের কারণে বাঙালিরা অসংখ্য বিপ্লবের চেষ্টা করেছিল। বাঙালিরা ইংরেজদের অভিসন্ধি যখন বুঝতে পারলো, তখনই তারা রাজস্ব দিতে অস্বীকৃতি জানায়। দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহ হয় ১৭৯৯ সালে, তাও সেনাবাহিনীর সাহায্যে দমন করা হয়।

বাঙালিদের ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলনের উজ্জ্বল অধ্যায়ের (১৭৬০-১৮০০) সূচনা হয় ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মাধ্যমে। সময়মত খাজনা দিতে না পারায় ভুমি থেকে উৎখাতকৃত কৃষকেরা তাদের সাথে যোগ দিয়ে সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে গণবিদ্রোহের রূপদান করেছিলেন। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ফকির সম্প্রদায়কে ডাকাত আখ্যায়িত করে তাদের আন্দোলন দমিয়ে দেয়। এই আন্দোলন প্রশমিত হওয়ার পূর্বেই সৈয়দ আহমেদ শহীদের নেতৃত্বে অনেক মুসলমান (বাঙালিসহ) উত্তর-পশ্চিম ভারতে দুর্নিবার ধর্মভিত্তিক তরিকা-ই-মুহম্মদিয়া আন্দোলন শুরু হলে ইংরেজদের বেকায়দায় পড়তে হয়। তাই ইংরেজরা কৌশল অবলম্বন করে মুসলমানদের সাথে শিখদের সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়। সৈয়দ আহমদের পক্ষে বহু বাঙালি লড়াই করেছিলেন বালাকোটের ময়দানে, কিন্তু শিখরাই অবশেষে জিতেছিল। এতে করে এই আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সৈয়দ আহমদের সংস্পর্শে এসে তিতুমীর মুসলিম সাধারণ সমাজ বিশেষ করে রায়তের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করে ১৮৩০-৩২। উত্তর চব্বিশ পরগনায় অবস্থিত নারকেলবাড়িয়ায় তিতুমীর বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে ইংরেজদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিতুমীর মারা গেলে তার দলের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। প্রায় একই সময়ে শুরূ হয়েছিল দক্ষিণ-মধ্য বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলন। এই আন্দোলনও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছিলো। হাজী শরীয়তুল্লাহ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলে তার ছেলে দুদু মিঞা পরে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল ছিলো চাষীদের কাছে ভয়ংকর।অবৈধ কর আদায়ের ব্যাপারে জমিদারদের পুরো ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিলো। বাংলার জমিদারদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু আর চাষী বা রায়তদারের অধিকাংশই ছিল মুসলমান, যে কারণে সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব দেখা দেয়। ইংরেজদের দ্বারা সৃষ্ট চিরস্থায়ী বন্দোবস্তই যে এই বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করেছিল তা অস্বীকার করা যায় না।

ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে সর্বশেষ এবং সর্বাপেক্ষা রক্তক্ষয়ী প্রয়াস ছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ। সেই সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিপাহীরা চট্টগ্রামের খাজাঞ্চিখানার কব্জা নেয়।[৯১] খাজাঞ্চিখানাটি বেশ কয়েকদিন সিপাহীদের দখলে ছিল। ১৮ নভেম্বর আরও বিদ্রোহী দেখা যায় যখন ৩৪তম বেঙ্গল ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের ২য়, ৩য় এবং ৪র্থ কোম্পানীগুলি চট্টগ্রাম কারাগার আক্রমণ করে সকল বন্দীদের মুক্ত করে। সিপাহীদের শেষ পর্যন্ত গোর্খা রেজিমেন্ট দ্বারা দমন করা হয়।[৯২] ইনকিলাব কলকাতা এবং পরে সাবেক রাজধানী ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে। শহরের লালবাগ থানা।লালবাগ এলাকার বাসিন্দাদের বিদ্রোহের কারণে রাত জেগে রাখা হয়েছিল।[৯৩] জলপাইগুড়ির সেনানিবাসের দখল নিতে সিপাহীরা আম-জনতার সাথে হাত মিলিয়েছিল। ১৮৫৮ সালের জানুয়ারিতে, অনেক সিপাহী ত্রিপুরার রাজপরিবার থেকে আশ্রয় পেয়েছিলেন।[৯১]


ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত করেন কিছু শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবী, যাঁদের পুরোধা ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস, সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি নরমপন্থীরা, এবং পরবর্তীকালে বিপ্লবাত্মক ভূমিকায় ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, রাসবিহারী বসু, ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, সূর্য সেন প্রমুখ বীর বিপ্লবীবর্গ।

বঙ্গভঙ্গ

ইতিহাসে দুবার বঙ্গভঙ্গ ঘটে: ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ রাজত্বকালে বঙ্গভঙ্গ, যাতে উদ্বেলিত বাঙালির প্রবল প্রতিবাদস্বরূপ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন হলে ১৯১১ সালে এই বঙ্গভঙ্গ রদ হয়।

দ্বিতীয়বার বাংলা ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় — বাংলার মুসলিমপ্রধান পূর্ব ভাগ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্গত হয় ও হিন্দুপ্রধান পশ্চিম ভাগ পশ্চিমবঙ্গ নামে ভারতের অংশ থাকে।

পূর্ব পাকিস্তান এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর হয় অধুনা স্বাধীন বাংলাদেশ

বাংলাদেশের জন্ম

Remove ads

ভৌগোলিক বিস্তার

সারাংশ
প্রসঙ্গ
বিশ্বব্যাপী বাংলা মাতৃভাষী জনসংখ্যা (মোট জনসংখ্যা ২৬.৫ কোটি ধরে)
  1. বাংলাদেশ (৬১.৩%)
  2. পশ্চিমবঙ্গ (ভারত) (২৮%)
  3. ভারতের অন্যান্য রাজ্য (৯.২%)
  4. অন্যান্য (১.৫%)
Thumb
ইউরোপীয়দের সাথে শ্যাম্পু প্রবর্তনের জন্য দীন মুহম্মদকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়।
Thumb
বাংলা টাউনে বিপুল সংখ্যায় বাঙালিরা বসবাস করেছে এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
Thumb
ইতেশামুদ্দীন ছিলেন পহেলা উচ্চশিক্ষিত বাঙালি এবং দক্ষিণ এশীয় যিনি ইউরোপ সফর করেছিলেন।

বাঙালিরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৯৮%।[৯৪] ভারতের জনগণনায় নৃগোষ্ঠী স্বীকৃত নয়, তবে দ্য ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুকের অনুমান অনুযায়ী ভারতে ১০ কোটি বাঙালি রয়েছে যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৭%।[৯৫] পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও আসামের বরাক উপত্যকা এবং নিম্ন অঞ্চল, ও পাশাপাশি ত্রিপুরা এবং মণিপুরের কিছু অংশে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।[৯৬] ত্রিপুরা এবং বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাঙালি-অধ্যুষিত জনসংখ্যার আবাসস্থল। এদের অধিকাংশই পূর্ব বাংলা (বর্তমানে বাংলাদেশ) থেকে হিন্দুদের বংশধর, যারা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর সেখানে চলে গিয়েছিল।[৯৭]:৩–৪[৯৮][৯৯] ভারত সরকারের পরবর্তী রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে কলোনাইজেশন প্রকল্পের মাধ্যমে এই এলাকাগুলোতে বাঙালি হিন্দুদের অভিগমন বৃদ্ধি পায়।

আদি অঞ্চলের বাইরে বাঙালি পরিবারদের মূলত উপমহাদেশের অন্যান্য অংশে, মধ্যপ্রাচ্যে ও পশ্চিমা বিশ্বে পাওয়া যায়। বাঙালি অভিবাসীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যা সৌদি আরব, পাকিস্তান এবং যুক্তরাজ্যে বিদ্যমান, যেখানে তারা দশ কোটিরও বেশি প্রতিষ্ঠিত সমাজ গঠন করে। বিদেশী বাঙালি প্রবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠই মুসলমান; হিন্দুধর্মে সমুদ্রভ্রমণ নিষিদ্ধ ছিল (যা কালা পানী নামে পরিচিত)।[১০০]

বাঙালিদের সাথে ইসলামের প্রবর্তন আরব দেশের সাথে একটি সংযোগ তৈরি করেছে, কারণ মুসলমানদের জীবনে একবার হজ্জ সম্পন্ন করার জন্য এই দেশে যেতে হয়। বাঙালি সুলতানরা হেজাজে ইসলামি মাদ্রাসাগুলোকে অর্থায়ন করত, যেটি আরবদের কাছে আল-মাদারিস আল-বাঙালিয়া নামে পরিচিত হয়। কথিত আছে যে চতুর্দশ শতাব্দীর নূর কুতুব আলম নামের একজন বাঙালি আলিম হজ্জ কয়েকবার সম্পন্ন করেছিলেন। বাঙালিরা কবে আরব দেশে বসবাস করতে শুরু করেছিল তা অজানা, যদিও জানা যায় যে হাজী শরীয়তুল্লাহর ওস্তাদ মাওলানা মুরাদ, যিনি উনিবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মক্কা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। ওমানের একজন কুরআন তর্জমান জহুরুল হক এবং জর্দানের শাহজাদা হাসান বিন তলালের বউ ছরবত আল-হাসান (শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী ইকরামউল্লাহর মেয়ে) মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী উল্লেখযোগ্য বাঙালি ব্যক্তি।

ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জের রাজত্বকালে ইউরোপে বাঙালিদের প্রথম অস্তিত্ব পাওয়া যায়। নদিয়ার একজন বাঙালি মৌলভী শেখ ইতেশামুদ্দীন ১৭৬৫ সালে মোগল সাম্রাজ্যের কূটনীতিক হিসেবে তার চাকর মুহম্মদ মুকীমের সাথে ইউরোপে আসেন।[১০১] এই কালেও জেমস অ্যাকিলিস কার্কপ্যাট্রিকের বাঙালি হুক্কা-বারদার কার্কপ্যাট্রিককে ডাকাতি ও প্রতারণা করে ইংল্যান্ডে চলে যান এবং নিজেকে সিলেটের শাহজাদা হিসাবে পরিচয় দিয়েছিলেন। উনাকে গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী জওয়ান উইলিয়াম পিট দ্বারা অপেক্ষা করা হয়েছিল এবং তারপরে রাজার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করার আগে ইয়র্কের ডিউকের সাথেও চা-নাশ্তা করেছিলেন।[১০২] আজ, ব্রিটিশ বাংলাদেশীরা যুক্তরাজ্যের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সমাজ। তারা দেশের ৯০% দক্ষিণ এশীয় রেস্তোরাঁ চালায়। দেশজুড়ে অসংখ্য বাঙালি জাতিগত ছিটমহল গঠন করেছে। এর মধ্যে পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেন উল্লেখযোগ্য, যা "বাংলাটাউন" নামে পরিচিত।[১০৩]

Remove ads

ভাষা

সারাংশ
প্রসঙ্গ
Thumb
বাঙালিদের সামাজিক স্তরায়নের প্রধান একটি নির্ধারক হচ্ছে আঞ্চলিক ভাষাসমূহ

বাঙালিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং একীকরণকারী বৈশিষ্ট্য হলো তাদের অধিকাংশই বাংলাকে তাদের মাতৃভাষা হিসাবে ব্যবহার করে। এই ভাষা ইন্দো-ইরানীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত বলে বিশ্বাস করা হয়। বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৪২ মিলিয়ন মানুষের মাতৃভাষা এবং মোট প্রায় ২৮৪ মিলিয়ন মানুষের কথ্য ভাষা হিসেবে বাংলা বিশ্বের ষষ্ঠ সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষার মর্যাদা রাখে। বাংলা অঞ্চলে এবং আশেপাশে বসবাসকারী অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতিদের মধ্যেও বাংলা একটি সাধারণ ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলা সাধারণত বাংলা লিপিতে লেখা হয় এবং খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে মাগধী প্রাকৃত থেকে এর উৎপত্তি ঘটেছে। পালি'র মতো প্রাচীন ভাষার সাথে এর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এর নিকটতম আধুনিক আত্মীয়দের মধ্যে হতে পারে অসমীয়া, ওড়িয়া এবং বিহারি ভাষাগুলি। যদিও বাংলায় ফারসি এবং সংস্কৃতের মতো ভাষা থেকে শব্দভাণ্ডার ধার করার একটি ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার থাকতে পারে, আধুনিক ধারকৃত শব্দগুলি মূলত ইংরেজি ভাষা থেকে আসে।

আজকের দিনে বাংলা ভাষার বিভিন্ন রূপ ব্যবহার হয় যা বাঙালি সংহতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই স্বতন্ত্র রূপগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমটি হলো ধ্রুপদী বাংলা (সাধু ভাষা) যা ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ পর্যন্ত সাহিত্যিক ব্যবহারেই সীমাবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয়টি হলো আধুনিক বাংলা (চলিত বা প্রমিত রূপ), যা সাহিত্যিক রূপ হিসেবে গণ্য হয়। এই রূপটি নদিয়া অঞ্চলের উপভাষার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে (যা নদিয়া এবং কুষ্টিয়া জেলা দুটির মধ্যে বিভক্ত)। বর্তমানে চলিত ভাষা লেখার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক ভাষণ, যেমন প্রস্তুত বক্তৃতা, কিছু বেতার সম্প্রচার এবং বিনোদন বিষয়বহির্ভূত অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। তৃতীয় এবং বাংলাভাষীদের মধ্যে বৃহত্তম বিভাগটি হলো কথ্য বাংলা (আঞ্চলিক বা কথ্য রূপ)। এগুলি আঞ্চলিক উপভাষা অনুসারে পরিবর্তিত অনানুষ্ঠানিক মৌখিক ভাষাকে বোঝায়।

Remove ads

সামাজিক স্তরবিন্যাস

সারাংশ
প্রসঙ্গ

বাঙালি জনগোষ্ঠীকে মূলত উপভাষার ভিত্তিতে বিভিন্ন উপগোষ্ঠীতে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়, যদিও সংস্কৃতির অন্যান্য দিকও এর সাথে জড়িত:

  • বাঙাল: পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত পূর্ববঙ্গীয়দের (যেমন বাংলাদেশী এবং যাদের পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছেন) বোঝাতে এই শব্দটি প্রধানত ব্যবহৃত হয়। পূর্ববঙ্গীয় উপভাষাগুলিকে বাঙ্গালি বলা হয়। এই গোষ্ঠীই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব করে। এরা মূলত বাংলাদেশের ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সিলেট, বরিশাল ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে।

বঙ্গালদের মধ্যে, চারটি উপগোষ্ঠী রয়েছে যারা তাদের (পূর্ব) বাঙালি পরিচয়ের সাথে আলাদা পরিচয়ও বহন করে। চট্টগ্রামের বাসিন্দারা চট্টগ্রাম বিভাগের (চট্টগ্রাম জেলা ও কক্সবাজার জেলা) অধিবাসী এবং চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে। মূলত কক্সবাজারের লোকেরা মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সিলেটীরা সিলেট বিভাগের অধিবাসী এবং সিলেটি ভাষায় কথা বলে। বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চল ও দক্ষিণ ত্রিপুরায় নোয়াখালীয় ভাষাভাষী রয়েছে। ঢাকাইয়া কুট্টিরা একটি ছোট, শহুরে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায় যারা সংস্কৃতিগত দিক দিয়ে ঢাকা বিভাগের বাকি অংশের লোকেদের থেকে কিছুটা আলাদা এবং পুরান ঢাকায় বাস করে।

  • ঘটি: পশ্চিমবঙ্গীয়রা তাদেরকে অন্য বাঙালিদের থেকে পৃথক করতে এই পরিভাষাটি বেশি ব্যবহার করে।

পুরুলিয়া এবং মানভূমের লোকেরা, যারা পশ্চিমবঙ্গের একেবারে পশ্চিমে বসবাস করে, উপভাষা এবং সংস্কৃতিগত কারণে মূল ঘটিদের থেকে কিছুটা আলাদা। অন্যান্য ঘটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘোষী এবং লোধা জাতি অন্তর্ভুক্ত।

উত্তরবঙ্গ অঞ্চলটি পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ উভয়ের মধ্যে বিভক্ত, যারা বারেন্দ্রি ও রংপুরি ভাষায় কথা বলে। আন্তর্জাতিক সীমান্ত নির্বিশেষে সাংস্কৃতিক মিল থাকা সত্ত্বেও, এদেরকে সাধারণত তাদেরকে সীমান্তের কোন দিকে বসবাস করে তার উপর ভিত্তি করে প্রথম দুটি প্রধান গোষ্ঠীর অংশ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। উত্তরবঙ্গীয়দের ঘটি বা বঙ্গাল হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। নিম্ন অসমের কিছু অংশেও রংপুরী ভাষাভাষী রয়েছে, অপরদিকে শেরশাহবাদিয়া সম্প্রদায় বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্যান্য উত্তরবঙ্গীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে খোট্টা এবং নশ্য শেখ।

বাঙালি হিন্দুরা সামাজিকভাবে চারটি বর্ণে বিভক্ত, যাকে চতুর্বর্ণ বলা হয়। বর্ণ ব্যবস্থা বর্ণ ও জাতি নিয়ে গঠিত হিন্দু ধর্মীয় ব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত। এটি মানুষকে চারটি রঙে বিভক্ত করে: সাদা, লাল, হলুদ এবং কালো। ব্রাহ্মণরা সাদা বর্ণের যারা পুরোহিত, শিক্ষক এবং ধর্মপ্রচারক হতে নির্ধারিত; লাল বর্ণের ক্ষত্রিয়রা, যাদের রাজা, শাসক, যোদ্ধা এবং সৈনিক হওয়ার কথা; বৈশ্য হলুদ বর্ণের, যারা গবাদি পশুপালক, কৃষক, কারিগর ও ব্যবসায়ী; এবং শূদ্ররা কালো এবং দ্বিজাতি বর্ণের লোকেদের সেবা করার জন্য শ্রমিক এবং কর্মচারী হিসেবে জন্ম নেয়। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সকল বর্ণের লোকজনের অস্তিত্ব রয়েছে। হিন্দু হিসেবে জন্মগ্রহণকারী রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা হিন্দুদের মধ্যে বর্ণপ্রথা, সতীদাহ প্রথা এবং বাল্যবিবাহের মত কুপ্রথা বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল।

Remove ads

ধর্ম

সারাংশ
প্রসঙ্গ
Thumb
বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ঈদুল আযহার নামাজ।
বাঙালিদের মধ্যে ধর্মবিশ্বাস[৩৬][১০৪][১০৫][১০৬][১০৭][১০৮]
ধর্ম অনুপাত
ইসলাম
 
৭০%
হিন্দুধর্ম
 
২৮%
অন্যান্য
 
২%

বাংলার প্রধান দুটি ধর্ম হলো ইসলামহিন্দুধর্ম। সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। সুন্নি মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও শিয়া মুসলিমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে বিদ্যমান। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০.৪% বাঙালি মুসলিম, যেখানে সমগ্র ভারতে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এটি প্রায় ৩০%। পশ্চিমবঙ্গে শিয়া নবাবদের রাজধানী মুর্শিদাবাদ জেলায় বাঙালি মুসলমানরা ৬৬.৮৮% সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। এককালে সুন্নি বাংলা সুলতানি রাজধানী মালদহ জেলায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রায় ৫১.২৭%। এছাড়াও, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় ৫৪,৮৭,৭৫৯ এরও বেশি বাঙালি মুসলমান বসবাস করে।

Thumb
কলকাতায় অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজা

বাঙালি জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের কিছু কম হিন্দু ধর্মাবলম্বী (যাদের অধিকাংশই শাক্ত ও বৈষ্ণব মতের অনুসারী)। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যা ৭০.৫৪% সংখ্যাগরিষ্ঠতা গঠন করেছে। দক্ষিণ আসামের বরাক উপত্যকা অঞ্চলে হিন্দুদের সংখ্যা ৫০%, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরায় ৬৮%, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ২৮%, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খণ্ডের ৯% বাঙালিদের বেশীরভাগই হিন্দু এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে ৭.৯৫% রয়েছে। বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে হিন্দুরা জনসংখ্যার ১৩.৫১% গঠন করে। ঢাকা বিভাগে হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ২৭ লক্ষের বেশি। দাকোপ উপজেলায় হিন্দুরা ৫৪.৪৫% সংখ্যাগরিষ্ঠ। জনসংখ্যার বিচারে, ভারত ও নেপালের পরে বাংলাদেশ হিন্দু জনসংখ্যার তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। বাংলাদেশের মোট হিন্দু জনসংখ্যা ইয়েমেন, জর্ডান, তাজিকিস্তান, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ওমান এবং অন্যান্য দেশের মতো অনেক মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলির জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায়। তাছাড়া, বাংলাদেশের মোট হিন্দু জনসংখ্যা গ্রীস ও বেলজিয়ামের মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান। বাঙালি হিন্দুরা স্থানীয় দেব-দেবীদেরও পূজা করে থাকে।

অপরদিকে, বাংলাদেশে বৌদ্ধ (দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ১%) এবং বাঙালি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষও বসবাস করে। কথিত আছে, পর্তুগিজ নাবিকদের বংশধরেরাই বাঙালি খ্রিস্টানদের একটি বড় অংশ। বাংলাভাষী বড়ুয়াদের একটি বড় সংখ্যা চট্টগ্রাম ও রাখাইনে বসবাসকারী বাঙালি বৌদ্ধদের অন্তর্ভুক্ত।

Remove ads

সংস্কৃতি ও লোকাচার

সারাংশ
প্রসঙ্গ
Thumb
মুর্শিদাবাদে বাংলার নবাবের শাহী ময়ূর বার্জের একটি ভাস্কর্য।

শিল্প ও স্থাপত্য

Thumb
জামদানী বুননের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি।

বাংলায় শিল্পকলার নথিভুক্ত ইতিহাস খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে পাওয়া যায়, যখন পোড়ামাটির ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছিল। শাহী বাঙ্গালার স্থাপত্যে জটিল কুলুঙ্গি স্তম্ভ সহ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদগুলির একটি স্বতন্ত্র শৈলী দেখা যায় যার কোন মিনার ছিল না। বাংলা শিল্পে হাতির দাঁত, মৃৎপাত্র ও পিতলেরও ব্যাপক ব্যবহার ছিল।

পোশাক

Thumb
কালা শেরওয়ানী পরা এক বাঙালি বর।
Thumb
কুর্তা ও শাড়ি পরিহিত এক বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের দম্পতি।

উত্তর ভারতীয় পোশাকের সঙ্গে বাঙালি পোশাকের মিল রয়েছে। মহিলারা শাড়ি পরেন তবে সাধারণ নকশার সালোয়ার কামিজও জনপ্রিয় আছে। ঐতিহ্যগতভাবে বাঙালি পুরুষরা জামা পরতেন, যদিও পাঞ্জাবির সঙ্গে সালোয়ার বা পায়জামার মতো পোশাক গত তিন শতাব্দীর মধ্যে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নৈমিত্তিক পরিবেশে বাঙালিদের মধ্যে ফতুয়া নামের একটি খাটো উপরের লেবাসের জনপ্রিয়তা অস্বীকার করা যাবে না। গাঁও-গেরামে বাঙালি পুরুষদের জন্য লুঙ্গি এবং গামছা একটি সাধারণ সংমিশ্রণ। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে ধুতি বেশি জনপ্রিয়। বিশেষ অনুষ্ঠানের সময়, বাঙালি মহিলারা সাধারণত শাড়ি, সালোয়ার কামিজ এবং মুসলিম মহিলারাবোরকা পরে যা একটি হিজাব বা ওড়না দিয়ে চুল ঢেকে রাখা হয়; এবং মুসলিম পুরুষেরা একটি পাঞ্জাবি পরে, যা একটি টুপি, তকি, পাগড়ি বা রুমাল দিয়ে চুল ঢেকে রাখা হয়।

মোগল বাংলার সবচেয়ে বিখ্যাত শৈল্পিক ঐতিহ্য ছিল সূক্ষ্ম মসলিনের উপর জামদানী মোটিফের বয়ন, যা এখন ইউনেস্কো একটি স্পর্শনাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে। পূর্ব বাংলার জামদানী তাঁতিরা বাদশাহী পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।[৮৩][১০৯]

সাহিত্য

বাংলা সাহিত্য বলতে বাংলা ভাষায় লেখার মূল অংশকে বোঝায়, যা প্রায় ১৩তম শতাব্দী ধরে বিকাশ লাভ করেছে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম বর্তমান রচনাটি চর্যাপদে পাওয়া যায়, এটি দশম ও ১১তম শতাব্দীর বৌদ্ধ রহস্যময় স্তোত্রগুলির একটি সংগ্রহ। ১৯০৭ সালে হর প্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ দরবারের লাইব্রেরিতে এগুলি আবিষ্কার করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের সময়রেখা তিনটি যুগে বিভক্ত - আদি (৬৫০-১২০০), মধ্যযুগ (১২০০-১৮০০) এবং আধুনিক (১৮০০-এর বাদে)। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে আব্দুল হাকিম, সৈয়দ সুলতান এবং আলাওলের লেখার মত ইসলামী মহাকাব্য সহ বিভিন্ন কাব্যিক ধারা রয়েছে। বাঙালি লেখকরা ধর্ম, সংস্কৃতি, সৃষ্টিতত্ত্ব, প্রেম ও ইতিহাসের মতো আখ্যান এবং মহাকাব্যের মাধ্যমে বিভিন্ন থিম অন্বেষণ করতে শুরু করেছিলেন। শাহী আদালতগুলি যেমন শাহী বাঙ্গালা এবং আরাকান রাজ্য শাহ মুহম্মদ সগীর, দৌলত কাজী এবং দৌলত উজির বাহরাম খানের মতো অগণিত বাঙালি লেখককে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল।

বাংলার নবজাগরণ বলতে ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে একটি সামাজিক-ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনকে বোঝায়, যা কলকাতা শহরের চারপাশে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল এবং প্রধানত ব্রিটিশ রাজের পৃষ্ঠপোষকতায় উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল যারা একটি সংস্কারধর্মী আন্দোলন তৈরি করেছিল যাকে বলা হয় ব্রাহ্মসমাজ। ইতিহাসবিদ নীতীশ সেনগুপ্ত বর্ণনা করেন যে বাংলার নবজাগরণ শুরু হয়েছিল রাজা রাম মোহন রায়ের সাথে এবং শেষ হয়েছিল এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাধ্যমে।[১১০] বাংলার নবজাগরণ প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেছিল ব্রিটিশ উপনিবেশকারীদের সাথে সম্পর্কের কারণে।[১১১] তথাপি এই যুগে আধুনিক মুসলিম সাহিত্যিকদের উদাহরণও ছিল। মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন আধুনিক যুগের প্রথম প্রধান লেখক যিনি বাঙালি মুসলিম সমাজ থেকে উঠে এসেছিলেন এবং বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখকদের একজন। তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা বিষাদ সিন্ধু বাঙালি পাঠকদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় ক্ল্যাসিক। কাজী নজরুল ইসলাম, যিনি সক্রিয়তা এবং ইংরেজ-বিরোধী সাহিত্যের জন্য উল্লেখযোগ্য, "বিদ্রোহী কবি" হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল এবং বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসাবে স্বীকৃত। বেগম রোকেয়া ছিলেন এই সময়ের নেতৃস্থানীয় মহিলা বাঙালি লেখিকা, যিনি সুলতানার স্বপ্ন রচনার জন্য সর্বাধিক বিখ্যাত যা পরবর্তীকালে বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছিল।

খাদ্য

Thumb
পান-সুপারি খাওয়া দাওয়ার সাধারণ সমাপ্তি
Thumb
সরিষায় পাবদা

দক্ষিণ এশিয়া থেকে বাঙালিদের একমাত্র ঐতিহ্যগতভাবে উন্নত মাল্টি-কোর্স ঐতিহ্য রয়েছে যা কাঠামোগতভাবে ফরাসী রন্ধনশৈলীর আধুনিক সেবা à la russe শৈলীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যেখানে খাবার একযোগে না দিয়ে কোর্স অনুযায়ী পরিবেশন করা হয়। কদীম বাংলার খাবার, মশলা, সবজির মাধ্যমে বাংলার তেজারতের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে। একটি প্রধান খাবার ভাতের সাথে পরিবেশন করা মাছ ও শাকসবজির উপর জোর দিয়ে, বাঙালি খাবার তার সূক্ষ্ম স্বাদের জন্য মশহুর, এবং মিষ্টান্ন এবং দুধ-ভিত্তিক মিষ্টির বিশাল বিস্তারের জন্য। বেশিরভাগ খাবারে একজন নিম্নলিখিত আইটেমগুলি পাবেন; সরিষার তেল, মাছ, পাঁচফোড়ন, ভেড়ার মাংস, পেঁয়াজ, চাল, এলাচ, দই ও মশলা। খাবারটি বর্তনে পরিবেশন করা হয় যার একটি স্বতন্ত্র ফুলের প্যাটার্ন প্রায়শই নীল বা গোলাপী রঙে থাকে। সাধারণ শরবৎগুলির মধ্যে রয়েছে, বোরহানি, ঘোল, মাঠা, লাচ্চি, ফালুদা, রূহ আফজা, প্রাকৃতিক রস যেমন আখের রস, খেজুরের রস, আমরস, দুধ চা, তালের রস, মসলা চা, সেইসাথে তুলসী বা তুকমা-ভিত্তিক শরবৎ। পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলার রান্নার অনেক মিল রয়েছে, কিন্তু একই সাথে অনেক অনন্য ঐতিহ্যও রয়েছে। এসব পাকঘর সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ইতিহাস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। পাকঘরগুলিকে আবার শহুরে এবং গাঁওয়ালী পাকঘরে ভাগ করা যায়। পূর্ব বাংলার শহুরে পাকঘরে বিদেশী মোগল প্রভাব সহ দেশী খাবার রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ পুরান ঢাকার হাজী বিরিয়ানি।

বিয়ে-শাদি

Thumb
কন্যার হাতে মেহেদি বাঙালি মুসলিম এবং হিন্দু সম্প্রদায় উভয়ের মধ্যেই প্রচলিত।
Thumb
বিয়ের সময় দোয়া করা বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের এক বিশেষ আচার অনুষ্ঠান।
Thumb
অগ্নিতে বরবধূ অঞ্জলি দিচ্ছে এটি একটি বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশেষ আচার অনুষ্ঠান।

বিয়ের সময় বাঙালিদের মাঝে শুধুমাত্র একটি অনুষ্ঠান হয় নি। আনুষ্ঠানিক বিয়ে তর্কাতীতভাবে বাঙালিদের মাঝে বিয়ের সবচেয়ে সাধারণ রূপ এবং সমাজে ঐতিহ্যগত বলে বিবেচিত হয়।[১১২] যদিও বহুগামিতা আজ বাঙালিদের মাঝে সাধারণত বিরল, তবে বিলাতী দখলের আগে এটি ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম ও হিন্দু উভয়ের মধ্যেই প্রচলিত ছিল এবং এটি ছিল সমৃদ্ধির একটি লক্ষণ। বিয়েকে দুই পরিবারের মিলন হিসেবে দেখা হয়, শুধু দুটি মানুষের না।[১১৩][১১৪] বিয়ে-শাদি পরিবার ও গ্রামের মাঝে সামাজিক বন্ধন বিকাশ এবং বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। দুই পরিবার ঘটক দ্বারা সাহায্য করা হয়, এবং প্রথম অনুষ্ঠানটি পাকা-দেখা বা দেখদেখি নামে পরিচিত, যেখানে যারা জড়িত তারা সবাই কন্যার মঞ্জিলে খাবার নিয়ে একে অপরের সাথে পরিচিত হয়। প্রধান অনুষ্ঠানটি হল পানচিনি বা চিনিপান, যা কন্যার পরিবারের দ্বারা আয়োজিত। এই অনুষ্ঠানে বরের পরিবারের কাছ থেকে সালামী পাওয়া যায় এবং বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়।[১১৫] একটি আড্ডা সংঘটিত হয় যখন তারা ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার, পান, চা এবং মিষ্টি খাওয়ায়। পরের ঘটনাটি হল মেহেদি সন্ধ্যা যা গায়ে হলুদ নামেও পরিচিত। তার পরে আসে প্রধান অনুষ্ঠান ওয়ালিমা যেখানে হাজার হাজার মেহমানের আয়োজন করা হয়। একটি আকদ হয়, যেখানে কাবিননামার দস্তখৎ করা হয়। একজন কাজী বা ইমাম সাধারণত এখানে হাজির থাকেন এবং দম্পতির জন্য কুরআন তেলাওয়াত ও দোয়া করেন। দামাদকে কন্যাকে মহর দিতে হয়। ফিরাযাত্রা বা ফিরাখাওয়া হল যখন কন্যা মা-বাপের বড়িতে ফিরে, যা তখন থেকে নাইয়র নামে পরিচিত হয়। পায়েস এবং দুধ সেখানে খাওয়ানো হয়। অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বউ-ভাত

বিজ্ঞান

Thumb

জগদীশ চন্দ্র বসু বাংলার বিজ্ঞান জগতের এক বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক। ইনি বিবিসির দ্বারা অনুষ্ঠিত সর্বশ্রেষ্ঠ ২০জন বাঙালির মধ্যে সপ্তম স্থান অধিকারী।

Thumb
বায়োমেডিকাল পদার্থবিদ খন্দকার সিদ্দিক-ই-রাব্বানী
Thumb
কাজী আজিজুল হক আধুনিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট বায়োমেট্রিক্সের উন্নয়নে অবদানের জন্য স্বীকৃত, যা বিশ্বব্যাপী জরূরী একটি আবিষ্কার।.

আধুনিক বিজ্ঞানে বাঙালিদের অবদান দুনিয়ার প্রেক্ষাপটে যুগান্তকারী। কাজী আজিজুল হক একজন উদ্ভাবক ছিলেন যিনি আঙ্গুলের ছাপ শ্রেণিবিন্যাসের পদ্ধতির পিছনে গাণিতিক ভিত্তি তৈরি করার জন্য শোহরৎ পেয়েছেন যা অপরাধ তদন্তের জন্য ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। আব্দুস সাত্তার খান মহাকাশযান, জেট ইঞ্জিন, রেলগাড়ী ইঞ্জিন এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাস টারবাইনে তেজারতী দরখাস্তের জন্য চল্লিশটিরও বেশি আলাদা সংকর ধাতু উদ্ভাবন করেন। ২০০৬ সালে, আবুল হুসসাম সোনো-আর্সেনিক ফিল্টার উদ্ভাবন করেন এবং ২০০৭ সালের গ্রেঞ্জার চ্যালেঞ্জ প্রাইজ ফর সাসটেইনেবিলিটির প্রাপক হন।[১১৬] স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা দুনিয়ার এক লাখ বিজ্ঞানীদের মধ্যে শীর্ষ ১% এর মাঝে আরেকজন বায়োমেডিকেল বিজ্ঞানী পারভেজ হারিসকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।[১১৭] খন্দকার সিদ্দিক-ই-রাব্বানী ফোকাসড ইম্পিডেন্স পরিমাপ তৈরি করেছেন, যা উন্নত জোন স্থানীয়করণের মাধ্যমে মানবদেহের কলায় বৈদ্যুতিক প্রতিরোধের পরিমাণ নির্ধারণের একটি কৌশল।[১১৮][১১৯]

উৎসব

Thumb
ঈদ মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব।

বাঙালিরা তাদের ধর্মের উপর নির্ভর করে ইসলামী ছুটির দিন বা হিন্দু উৎসবগুলোকে স্মরণ করে। প্রধান ইসলামী ছুটির সময় ঈদুল আযহা এবং ঈদুল ফিতরের, গরীবকে যাকাতসদকা দেওয়া হয়।[১২০] বাচ্চাদের লেবাস বা টাকা দেওয়া হয়। খেশ, দোস্তগণ, পড়শীরা ঘুরে বেড়ায় এবং খাবার, মিষ্টি বিনিময় করে।[১২১] হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দুর্গাপূজা, দীপাবলি,দোলযাত্রা, জন্মাষ্টমী। এই প্রমুখ উৎসবগুলোতে বিশেষ ভাবে ছুটি প্রদান করা হয়। অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবগুলির মধ্যে রয়েছে কালী পূজা, ফলহারিণী কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, অন্নকূট ইত্যাদি। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে হিন্দুদের মধ্যে বিভিন্ন মন্দির, মঠ এবং আশ্রম-এ যাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এছাড়াও দুর্গাপূজার সময় নতুন জামাকাপড় কেনাকাটা করা হয় নিজেদের জন্য ও আত্মীয় স্বজনদের দেওয়ার জন্য।

Thumb
দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব।

উল্লেখযোগ্য তামাদ্দুনিক অনুষ্ঠান সম্প্রদায় দ্বারা বার্ষিক উদযাপিত হয়। পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের এবং গ্রীষ্মের আগমনের উদযাপন। এটি একটি মজার মেলা, মঞ্চে লোকেরা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।[১২২] পহেলা ফাল্গুন (বসন্ত) এর মতো উত্সবগুলিও তাদের ধর্ম নির্বিশেষে পালিত হয়। ঢাকার বাঙালিরা শাকরাইন উদযাপন করে, একটি বার্ষিক ঘুড়ি উৎসব। নবান্ন হল পশ্চিমা দুনিয়ার ফসল কাটার উৎসবের অনুরূপ একটি বাঙালি উদযাপন।

খেলাধুলা

Thumb
টাঙ্গাইলে লাঠি খেলার আয়োজন।
Thumb
বর্ষা মৌসুমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে একটি নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা।

ঐতিহ্যবাহী বাংলা খেলায় বিভিন্ন মার্শাল আর্ট এবং বিভিন্ন রেসিং স্পোর্টস অন্তর্ভুক্ত ছিল, যদিও বিলাতী-প্রবর্তিত খেলা ক্রিকেট এবং ফুটবল এখন বাঙালিদের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয়। ঐতিহাসিকভাবে, লাঠি খেলা ছিল লড়াইয়ের এমন একটি পদ্ধতি যা নিজের জমি ও ধন-দৌলৎ হেফাজৎ করার জন্য বা অন্যের জমি ও ধন-দৌলৎ দখলের একটি উপায়। বাংলার জমিদাররা প্রশিক্ষিত লাঠিয়ালদের নিয়োগ করতেন হেফাজতের একটি রূপ হিসেবে এবং প্রজাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক কর আদায়ের উপায় হিসেবে।[১২৩] দেশব্যাপী লাঠি খেলা প্রতিযোগিতা ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত কুষ্টিয়ায় প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হতো, যদিও এর অনুশীলন এখন হ্রাস পাচ্ছে এবং নির্দিষ্ট কিছু উৎসব ও উদযাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।[১২৪] কুস্তি আরেকটি জনপ্রিয় লড়াইয়ের খেলা যার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ আছে। যেমন; ১৮৮৯ সালে চাটগাঁর জমিদার কাদির বখশ শুরু করলেন বলীখেলা। আব্দুল জব্বার নামে পরিচিত একজন সওদাগর ১৯০৭ সালে এমন একটি খেলা গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে বলীখেলাকে অভিযোজিত করেছিলেন যা বাঙালিদের বিলাতী হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তৈয়ার করবে। এখন এটি জব্বারের বলীখেলা নামে পরিচিত।[১২৫][১২৬] ১৯৭২ সালে, কাবাডি নামে একটি জনপ্রিয় দলগত খেলা বাংলাদেশের জাতীয় খেলায় পরিণত হয়। এটি হাডুডু খেলার একটি নিয়ন্ত্রিত সংস্করণ যার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ অ্যামেচার কাবাডি ফেডারেশন গঠিত হয়।[১২৭] ব্যুত্থান হলো বিংশ শতাব্দীর একটি বাঙালি মার্শাল আর্ট যা গ্র্যান্ডমাস্টার ম্যাক ইউরীর উদ্ভাবিত। এটি এখন আন্তর্জাতিক ব্যুত্থান ফেডারেশনের অধীনে দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে চর্চা করা হয়।[১২৮]

Thumb
মহম্মদ সালিম, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ফুটবলার যিনি বিদেশি ক্লাবে খেলেছেন। খালি পায়ে খেলার কারণে, তিনি তাদের ১৯৩৬ সালে জিমি ম্যাকমেনেমি দ্বারা ব্যান্ডেজ করাচ্ছেন।
Thumb
সৌরভ গাঙ্গুলি প্রাক্তন ভারতীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলের অধিনায়ক তথা বর্তমান বিসিসিআই এর প্রধান সভাপতি।

নৌকা বাইচ হলো একটি বাঙালি নৌ-দৌড় প্রতিযোগিতা যা বর্ষাকালে এবং বর্ষাকালের বাদে খেলা হয় যখন অনেক জমি পানির নিচে চলে যায়। লম্বা ডিঙিগুলিকে খেল নাও হিসাবে উল্লেখ করা হয় এবং গানের সাথে করতালের এস্তেমাল ছিল সাধারণ। বাংলার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের খেল নাও এস্তেমাল করা হয়।[১২৯] ঘোড়দৌড় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজাদের দ্বারা পৃষ্ঠপোষকতা হতো এবং তাদের চলনবিল ঘোড়দৌড় বহু শতাব্দী ধরে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

Thumb
ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান বর্তমানে ওডিআই ক্রিকেটের জন্য তামাম ফরম্যাটে দুনিয়ার সেরা অল-রাউন্ডারের তাজদার,[১৩০] এবং সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের একজন।[১৩১][১৩২][১৩৩][১৩৪][১৩৫][১৩৬][১৩৭]

কলকাতার মহম্মদ সালিম ১৯৩৬ সালে ইউরোপীয় ফুটবল ক্লাবের হয়ে প্রথম দক্ষিণ এশীয় লোক হয়েছিলেন।[১৩৮] স্কটল্যাণ্ডের সেল্টিক এফ.সি-র হয়ে তার দুটি উপস্থিতিতে, তিনি পুরা ম্যাচ খালি পায়ে খেলেছেন এবং বেশ কয়েকটি গোল করেছেন।[১৩৯] অ্যাস্টন ভিলার ডিফেন্ডার, নেইল টেলর এবং লেস্টার সিটির মিডফিল্ডার হামজা চৌধুরী হলেন প্রিমিয়ার লিগে খেলা প্রথম বাঙালি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়। চৌধুরী ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২১ দলের হয়েও খেলেছেন এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় যে তিনিই প্রথম দক্ষিণ এশীয় লোক যিনি ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলেন।[১৪০]

বোর্ড এবং ঘরের খেলায় যেমন পঁচিশী এবং এর আধুনিক প্রতিরূপ লুডো, সেইসাথে লাটিম, ক্যারাম বোর্ড, চোর-পুলিশ, কানামাছি এবং শতরঞ্জের ক্ষেত্রে বাঙালিরা খুব প্রতিযোগিতামূলক। রানী হামিদ দুনিয়ার অন্যতম সফল শতরঞ্জ খেলোয়াড়, এশিয়া ও ইউরোপে একাধিকবার চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। রামনাথ বিশ্বাস একজন বিপ্লবী সৈনিক যিনি ১৯ শতকে ঠ্যাংগাড়ীতে তিনটি দুনিয়া-সফর করেছিলেন।

Remove ads

বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব

সারাংশ
প্রসঙ্গ

বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাঙালী

অতীতের শাসকবৃন্দ

সমুদ্র সেন ও চন্দ্র সেন (মহাভারত)

স্বাধীনতা সংগ্রামী

ভাষাসৈনিক

বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা

বাঙালি বীরশ্রেষ্ঠ

আরও তথ্য ক্রম, নাম ...

রাজনীতিক

নোবেলজয়ী বাঙালী

কবি

সাহিত্যিক

লেখক

ইতিহাসবিদ

বাঙালি দার্শনিক

বাঙালি বিজ্ঞানী

নট ও নাট্যকার

চলচ্চিত্র পরিচালক

সত্যজিৎ রায়

জহির রায়হান

ঋত্বিক ঘটক

তপন সিনহা

চাষী নজরুল ইসলাম

সৃজিত মুখোপাধ্যায়

ঋতুপর্ণ ঘোষ

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়

অপর্ণা সেন

মৃণাল সেন

রাজ চক্রবর্তী

গৌতম ঘোষ

বাউল সাধক

সাধক - সাধিকা

গায়ক ও সঙ্গীতজ্ঞ

গীতিকার

সুরকার

খেলোয়াড়

Remove ads

আরও দেখুন

উদ্ধৃতি

বহিঃসংযোগ

Loading related searches...

Wikiwand - on

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Remove ads